সাকিব, সদর উপজেলা (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪ টি শরণার্থী শিবিরে সরকারের হিসাব অনুযায়ী ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদেরকে আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে ৮ হাজার একরেরও বেশি বনভূমি।
বন-বিভাগ মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে বিপুল পরিমাণ ধ্বংস হওয়া বনজ এবং জীব বৈচিত্রের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করেছে মাত্র ২৪২০ কোটি টাকা। এতে জীব বৈচিত্রের ক্ষতি ১৮২৯ কোটি টাকা এবং বনজ দ্রব্যের ক্ষতি ৫৯১ কোটি টাকা। সম্প্রতি এই প্রতিবেদন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। পরে সংসদীয় কমিটি অক্টোবরে কক্সবাজারে বৈঠক করে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকে পরিবেশবাদী সংগঠন এবং নেতাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বলছেন, এটি একটি সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর ভুল প্রতিবেদন। এই ধরণের ভুল প্রতিবেদনের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ পুনরুদ্ধারে তহবিল সংগ্রহে বাংলাদেশকে সমস্যায় পড়তে হবে।পরিবেশবাদী নেতাদের দাবী, বন-পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি অতুলনীয়। এই ক্ষতি অনুমান করে নির্ণয় করার মতো নয়। এটি নির্ণয় করতে হলে বিশেষজ্ঞ কমিটি দরকার। বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে সঠিক হিসাব নিরূপণ করলে ক্ষতির সঠিক হিসাব বেরিয়ে আসবে।
গত ১৮ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে বন-পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে বনবিভাগ যে প্রতিবেদন তৈরী করেছে সেটি উপস্থাপন করা হয়।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতির প্রতিবেদনটি তৈরী করেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ। দক্ষিণ বনবিভাগ সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে তড়িঘড়ি করে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপনের কারণে বন-পরিবেশের ক্ষতির একটি প্রতিবেদন চাওয়া হয়। পরে ৯ অক্টোবর প্রধান বন সংরক্ষক বরাবরে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়।প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের কারণে ৮ হাজার একর বন ধ্বংস হয়েছে। এরমধ্যে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে ৬ হাজার ১৬৪ একরের উপর। আর রোহিঙ্গাদের জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে ১ হাজার ৮৩৭ একর। সেখানে শত বছরের প্রাকৃতিক বন ৪ হাজার ১৩৬ একর এবং সামাজিক বন ২ হাজার ২৭ একর। এতে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ২৪২০ কোটি টাকা। এরমধ্যে জীববৈচিত্রের ক্ষতি ধরা হয়েছে ১৮২৯ কোটি টাকা এবং বনজ দ্রব্যের ক্ষতি ৫৯১ কোটি টাকা।
কিভাবে প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে এমন প্রশ্নের? জবাবে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ প্রকল্পে যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি নির্ণয় করা হয়েছে সেটার আনুপাতিকহারে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বনজ ও জীববৈচিত্রের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে।ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি ব্যবহার করা হয়নি।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেখানে সৃজিত বন, প্রাকৃতিক বন ও আর জীববৈচিত্রের মূলত তিনভাগে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্রমতে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের কারণে পরিবেশের অতুলনীয় ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ এবং জীববৈচিত্রের ক্ষতি যেভাবে উঠে আসা প্রয়োজন ছিল বনবিভাগের প্রতিবেদনে সেভাবে উঠে আসেনি। বরং ক্ষয়-ক্ষতি নির্ণয়ের নামে ‘তামাশা’ করা হয়েছে বলে দাবী করছে পরিবেশবাদীরা।
কক্সবাজার ‘সিএসও-এনজিও’ ফোরাম (সিসিএনএফ) এর কো-চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টটি নিয়ে আমরা সন্দিহান। কারণ সেখানে ‘প্রকৃত ক্ষয়-ক্ষতির’ বিষয় তুলে ধরা হয়নি। এটি তড়িঘড়ি করে নির্ণয়ের বিষয় নয়, প্রকৃত ক্ষয়-ক্ষতি নির্ণয় করতে হলে এক্সপার্ট দল এবং গবেষণার বিষয় আছে। আমরা জানি না আদৌ সেটা করা হয়েছে কিনা। আন্দাজ নির্ভর প্রতিবেদনের ফলে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ পুনরুদ্ধারের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে গেলে নতুন করে সংকটের মুখোমুখি হবে এবং এই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায় এড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে।
আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, উখিয়া-টেকনাফের প্রাকৃতিক বন শত শত বছরের পুরনো। সেখানে অনেক ধরণের বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ এবং ফ্লোরা ছিল। যেগুলোর মূল্য ধরতে হলে গভীর গবেষণা দরকার। ফ্লোরা এক জাতীয় উদ্ভিদ যা নতুন উদ্ভিদ জন্মাতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এই ফ্লোরা বনের জন্য অমূল্য সম্পদ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এটার দাম নির্ধারণ করলে টাকার সংখ্যা দাঁড়াবে বিশাল।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপনের জন্য যে উদ্ভিদ বা গাছগুলো স্বমূলে ধ্বংস করা হয়েছে সেগুলোর কার্বন ইনভেন্ট্রির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। শুধুমাত্র একটি গাছকে গাছ হিসাব করে সেটার বাজার দর নির্ধারণ করা হয়েছে। যেটা আসলে হাস্যকর। আবার অন্যদিকে গাছগুলো অক্সিজেন সরবরাহ করতো। কিন্তু বনবিভাগের প্রতিবেদনে অক্সিজেন নিঃসরণ মূল্যও উঠে আসেনি। এটার ফলে এই অঞ্চলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নৈতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া ধ্বংস হওয়া বনের ইকো-সিস্টেমের যে ক্ষতি হয়েছে সেগুলোও সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি।
খোকা বলেন, হাজার হাজার গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ইতোমধ্যে কৃষি এবং সুপেয় পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এছাড়া বন্যপ্রাণীর জলাধার শেষ হয়ে গেছে। সবকিছুর উপর জরিপ করে ক্ষতি নির্ধারণ করতে হবে।
সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশের সভাপতি আ.ন.ম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে বসতি স্থাপনের জন্য ছোট-বড় প্রায় ৬৫ টি পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড় কখনোই পূণনির্মাণ করা যায় না। কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণের ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত পাহাড়গুলোকে আনা হয়নি। আনলে শুধু পাহাড়ের ক্ষতির পরিমাণই অনেকগুণ ছাড়িয়ে যেত। আবার নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে নদ-নদী ভরাট হয়েছে, ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। এরজন্য বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে সঠিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরতে হবে।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।
Leave a Reply